গল্প- সাহেব পাড়ায় টিউশনি

সাহেব পাড়ায় টিউশনি
-সুনির্মল বসু

 

 

মিসেস মুখার্জী একদিন বললেন, বাইরে পড়িয়ে যে টাকা পান, তার চেয়ে অনেক বেশি পাবেন, আপনি সাহেব কোয়ার্টারে পড়ান।
সংসারের প্রয়োজন ছিল। রাজি হয়ে গেলাম। প্রথমে চিফ মেডিকেল অফিসারের বাড়িতে পড়ানো। ছেলেটি পড়াশুনায় ভালো, নামী স্কুলের ছাত্র। ও রেজাল্ট ভালো করলো, আমার টিউশনির পশার বাড়লো। এখানে তখন যেসব শিক্ষকেরা পড়াতেন, তারা চল্লিশ মিনিটের বেশি পড়াতেন না। এত কম সময়ে কি করে পড়ানো সম্ভব, আমি ভেবে পেতাম না। ফলে, রাতারাতি আমার টিউশনি বাড়তে থাকল।
চারদিকে বাউন্ডারিতে ঘেরা অন্য রকম পৃথিবী।
বিকেল পাঁচটার পর অফিস ছুটি হলে, ওয়েলফেয়ার অফিসার ও চিফ মেডিকেল অফিসার ক্লাবে আকন্ঠ মদ খেয়ে, কবে কখন বেলঘরিয়ার মাঠে ফুটবল খেলতে গিয়ে গোল করেছিলেন, তাই নিয়ে তর্ক জুড়ে দিলেন। বছর দুই বাদে ওয়েলফেয়ার অফিসার একদিন আমাকে ডেকে বললেন, সুনির্মল, তুমি জানো, ডাক্তার আমার সব খাবার বন্ধ করে দিয়েছে। এখন আমি ভাত আর পেঁপে সেদ্ধ খাচ্ছি।
রাত্রি আটটার পর, গেট পেরিয়ে ভেতরে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। আমাকে পড়িয়ে রাত সাড়ে নটার মধ্যে বেরিয়ে আসতে হোত। ক্লাস টেনের একটি ছাত্র অজয় মজুমদারের কথা মনে আছে। এইটুকু বয়সে সে এমন এমন কথা বলতো, আমি ভাবতাম,
এত অল্প বয়সে কি করে কাঁচা বাঁশে ঘুন ধরলো।
পরে বুঝেছি, এখানকার আবহাওয়া এই রকম।
এখানে কিছু ভাল ছাত্র-ছাত্রীও পড়িয়েছি। অ্যাসিস্ট্যান্ট ফ্যাক্টরি ম্যানেজারের মেয়ে শ্রাবণী, সে এখন অস্ট্রেলিয়াতে আছে, ভারী সুন্দর ছিল তার ব্যবহার। পড়াশোনাতে যথেষ্ট ভালো। অ্যাসিস্ট্যান্ট ফ্যাক্টরি ম্যানেজার নিজেও খড়গপুর আইআইটির
ইঞ্জিনিয়ার। দারুন ছবি আঁকেন। একদিন পড়াতে গিয়ে দেখি, তার ফুলের বাগানে বসে আছে একটি সাদা লক্ষীপেঁচা। উনি বললেন, দাঁড়ান ,আমি ওর ছবি আঁকবো।

এখানে টিউশনি করতে গিয়ে কখনো কখনো বিপন্ন অবস্থায় পড়েছি। এটা প্রথম দিকের ঘটনা। তখন দুটো বাড়িতে পড়াই। সন্ধে ছটায় ঢুকেছি, রাত নটায় বেরোবার সময়, মিসেস ধানুকা বললেন, বসুন স্যার, ছাত্রের পড়াশোনার ব্যাপারে কথা আছে।
আমি ছাত্র সম্পর্কে আমার মতামত জানিয়ে বের হয়ে এলাম।
পরদিন আবার তিনি আমায় ডেকে বসতে বললেন,
ভদ্রমহিলা দারুণ সুন্দরী। কিন্তু সন্ধ্যার পর অনেকটা মদ খেয়ে বেসামাল অবস্থা। আমি বললাম, আমাকে বাজার থেকে একটা জিনিস কিনতে হবে। এই বলে কোনমতে সে যাত্রায় বেঁচে গেছি। পরে আর ওখানে পড়াতে যায়নি।
সমরজিৎ বলে একটা সুদর্শন ছাত্রকে পড়াতে গিয়েছিলাম, যে ইতিমধ্যেই কলকাতার বহু নামী স্কুল থেকে বিতাড়িত হয়ে এসেছে। আমি শরৎচন্দ্র সম্পর্কে বোঝাতে শুরু করতেই, সে আমাকে থামিয়ে দিয়ে ঘরে গেল, আধঘন্টা পর এক থালা
লুচি নিয়ে খেতে বসে গেল। ঘন্টাখানেক কাটবার পর, বলল, তাহলে পরদিন শুরু করা যাবে।
আবার একবার অনিন্দিতা বলে একটি মেয়েকে রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়াচ্ছি, ও বুঝতে পারছে না।
আমি চেষ্টা করে চলেছি। ওর বাবা ঘরে ঢুকে বললেন, বুঝতে পারছিস না, আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি,
তারপর তিনি কবিতাটির সম্পূর্ণ ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে গেলেন। আমিতো ছাত্রীকে সংশোধন করতে পারি, তার অভিভাবক কে সংশোধন করতে গেলে, টিউশনি রাখাই সমস্যা হয়ে পড়ে।
সাহেবপাড়ায় টিউশনিতে সমস্যা হতো, 31শে ডিসেম্বর। ঐদিন ক্লাব হাউসে নাচের আসর বসতো।
পড়াতে গিয়ে গেটে দারোয়ান আমায় আটকে দিলো, ভেতরে যাওয়া যাবে না। বললাম, আপনি আমাকে চেনেন না, যিনি আমাকে চেনেন, তিনি আপনাকে আমাকে চিনিয়ে দেবেন।
চিফ মেডিক্যাল অফিসার ফোন করতেই দারোয়ান অবস্থান বদল করে ফেললেন, বললেন, হে হে, যাইয়ে মাস্টার সাব, যাইয়ে।
দিনগুলো পেছনে সরে গিয়েছে। রেখে গিয়েছে অম্লমধুর অভিজ্ঞতা। মাঝে মাঝে স্মৃতির বন্ধ দুয়ার খুলে চেয়ে দেখি, এ জীবন আমায় কত যে অভিজ্ঞতা, কত যে বৈচিত্র্যময় সময়ের ছবি এনে দিয়েছিল। জীবনের কোনো কিছুই মূল্যহীন নয়, প্রতিদিনের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে জীবনকে নব নব রূপে জানা হতে থাকে, আজকে যা স্মৃতি, কাল তা ইতিহাস।
আমার জীবনের পুরনো ইতিহাসের এক পাতা আজ সকলের সামনে তুলে ধরলাম।

Loading

Leave A Comment